মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০১৪

মেরী অলিভারের কবিতা

মেরী অলিভার এ সময়ের প্রধান আমেরিকান কবি। জন্ম ১৯৩৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর। কবিতার জন্য পুলিত্‌জার পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড, শেলী মেমরিয়্যাল এওয়ার্ড সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। মেরী অলিভারের কবিতায় বারবারই মানুষ এবং প্রকৃতি একজন আর একজনের শরীর জড়িয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর সে মানুষ জীবন-মৃত্যু-অস্তিত্বের সব প্রশ্নের মাঝ দিয়ে নির্ভয়ে এক অপূর্ব শান্তির পথে হেঁটে গেছে। প্রতিবার যখনই পড়ি “You do not have to walk on your knees for a hundred miles through the desert repenting. You only have to let the soft animal of your body love what it loves.” – এক অদ্ভুত ভরসা পাই। মনে হ’য় সত্যিই বুঝি ক্ষমা আছে, আছে মুক্তি। বড় বেশি লোভ হ’য় বেঁচে থাকবার!



  
বুনো হাঁস

অমন ভালো মানুষটি হ’তে হ’বে না তোমায়।
দু’ হাঁটুতে ভর ক’রে, অনুতাপ ক’রতে ক’রতে
মরুভূমির মাঝ দিয়ে
শ’খানেক মাইল হেঁটে যেতে হ’বে না।
শুধু শরীরের ভিতর নরম জন্তুটা যা ভালোবাসে
তাকে তা ভালোবাসতে দাও ।
আমায় তোমার হতাশার কথা ব’ল, তোমার,
আমি তোমায় আমারটুকু ব’লব।
এবং এর মাঝে পৃথিবী এগিয়ে যাবে।
এর মাঝে সূর্য আর বৃষ্টি ভেজা ঝকঝকে নুড়িপাথর
ভুদৃশ্যের মাঝ দিয়ে...
চলেছে প্রেইরি, ঘন গাছপালা,
পাহাড় আর নদীর উপর দিয়ে
আর সবকিছুর ভিতর নির্মল, নীল বাতাসে
বুনোহাঁস উঁচু থেকে উঁচুতে
উড়ে যাচ্ছে, আবার ওরা ঘরে ফিরছে।
তুমি যেই হও না কেন, যতই নিঃসঙ্গ
পৃথিবী নিজেকে তোমার কাছেই উৎসর্গ করে, তোমার কল্পনার কাছে,
সে তোমায় বুনো হাঁসের মত ডাকছে। কর্কশ, রোমাঞ্চকর-
সবকিছুর মাঝে
তোমার স্থানটুকু ঘোষণা ক’রে
সে শুধু বারবার ডাকছে।


বনের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা

ভেবেছিলাম এই পৃথিবী আমাকে মনে রেখেছে,
কত নরমভাবে সে আমায় ফিরিয়ে নিয়েছিল,
ঘন কালো স্কার্ট জড়োসড়ো করতে করতে,
পকেটভর্তি তার লাইকেন আর বীজ।
কোনদিন আমি এমন গভীর ঘুম ঘুমাই নি, নদীতীরে একটা পাথর যেন।
আমার আর তারাদের শাদা আগুনের মাঝে অন্য কোন বাধা নেই
শুধু আমার চিন্তাগুলো, নিখুঁত গাছগুলোর ডালপালার
ভিতর দিয়ে রাতের প্রজাপতির মত ভেসে বেড়াচ্ছে।
সারারাত আমি আমার চারপাশে
ছোট ছোট সাম্রাজ্যের নিঃশ্বাস নেওয়া শুনলাম,
আমার চারপাশে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, পতঙ্গরা
আর সেইসব পাখি যারা অন্ধকারের মাঝেই সবকিছু ক’রে।
সারা রাত আমি যেন জলের ভিতর উঠে দাঁড়ালাম আর পড়ে গেলাম
দৃঢ়ভাবে দু’ হাতের মুঠায় খামচে ধরলাম কোন এক উজ্জ্বল শেষ বিচার, ভোর হ’তেই
আমি এর চেয়ে ভালো অন্য আর কিছুর ভিতর
কমপক্ষে বারো বার উধাও হ’য়ে গেলাম।


বৃষ্টি

১।
পুরোটা বিকেল বৃষ্টি হ’ল, তখন
মেঘের ভিতর থেকে হলুদ সূতায়
এমন শক্তি নেমে এল
ঈশ্বরের যেমন ক্ষমতাশালী হওয়া দরকার
ঠিক তেমন।
আর যখন তা গাছের গায়ে আঘাত ক’রল
তার শরীর চিরদিনের জন্য প্রস্ফুটিত হ’য়ে উঠল।

২। জলাভূমি
কাল রাতে, বৃষ্টির মধ্যে বেশ কিছু বন্দি
জেলখানার কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে উঠছিল।
অন্ধকারের ভিতর ওরা ভাবছিল,
কি জানি এ কাজ পারবে কিনা,
কিন্তু চেষ্টা যে করতেই হ’বে।
অন্ধকারের ভিতর তারা কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে উঠছিল, মুঠো মুঠো কাঁটাতার।
অন্ধকার হ’লেও বেশির ভাগই ধরা পড়ে গেল।
ওদের শিবিরের ভিতর পাঠিয়ে দে’য়া হ’ল।
কিন্তু কয়েকজন এখনও কাঁটাতার বেয়ে বেয়ে উঠছে। কিংবা কাদাজলের ভিতর দিয়ে
অন্য পাশের নীলরঙ্গা বিলের মাঝ দিয়ে পার হচ্ছে।

যখন কেউ মুঠোর ভিতর শক্ত ক’রে কাঁটাতার খামচে ধরে, কেমন লাগে?
নরম পাউরুটির মত? কিংবা যেন এক জোড়া জুতা?
যখন কেউ মুঠোর ভিতর শক্ত ক’রে কাঁটাতার খামচে ধরে, কেমন লাগে?
থালা আর কাঁটাচামচের মত? কিংবা যেন মুঠো ভরতি ফুল?
  
যখন কেউ মুঠোর ভিতর শক্ত ক’রে কাঁটাতার খামচে ধরে, কেমন লাগে?
যেন দরজার কড়া? দরকারি কাগজ? পরিষ্কার চাদর যা কিনা
শরীরের উপর টেনে নিতে ইচ্ছে ক’রে?

৩।
কিংবা এমন কোন ছবি - এক বৃষ্টির দিনে, আমার কাকা
ফুলের বিছানায় শুয়ে আছেন,
ঠান্ডা, ভেঙ্গে চুরে যাওয়া এক মানুষ,
তাকে টেনে নামানো হ’ল
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা গাড়ি থেকে
ঝুলে পড়া ছেঁড়া  খোড়া  কাপড়ের ভিতর থেকে
জ্বলজ্বল ক’রতে থাকা  দীর্ঘ লম্বা হোসের মাঝ থেকে।
বাবা চিত্‌কার ক’রে উঠলেন,
এম্বুলেন্স এল,
তখন আমরা সবাই
মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এম্বুলেন্স তাকে নিয়ে চলে গেল।
বাড়ির বারান্দা থেকে
বাবাকে দেখবার জন্য
আমি আবার ঘুরে দাঁড়ালাম
বাবা তখনো
ফুলের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিলেন,
তখনো তিনি এক চলত্‌শক্তিহীন কাদামাটি মাখা মানুষ
বৃষ্টির ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা এক অতি ক্ষুদ্র মানুষ।

৪। খুব ভোর, আমার জন্মদিন

শামুকগুলো তাদের শরীরের গোলাপি স্লেড-এ চেপে
মর্নিং গ্লোরি ফুলের মাঝ দিয়ে চলেছে।
বুড়ো আঙ্গুলের মত দেখতে র‍্যাস্পবেরির মাঝে
মাকড়সা ঘুমিয়ে আছে।
কি করব? আমি কি করব?

ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়ছে।
ছোট পাখিগুলো তার ভিতর বেঁচে আছে।
এমন কি কাঁচপোকাও।
সবুজ পাতারা যেন চেটেপুটে সব বৃষ্টি খেয়ে ফেলছে।
কি করব? আমি কি করব?

বোলতা তার কাগজের রাজপ্রাসাদের বারান্দায় বসে থাকে।
নীলরঙ্গা সারস মেঘের মাঝ থেকে ভেসে আসে।
কালো জলের ভিতর থেকে
মাছ লাফ দিয়ে উঠে,
দেখে মনে হ’য় জলের মাঝ থেকে বুঝি লাফ দিয়ে উঠল রংধনু আর মুখ ।

এই ভোরে মনে হচ্ছে জলের ভিতর শাপলারা
যেন ম্যনের শাপলা থেকে কিছু কম সুন্দর নয়।
এবং আমি এর চেয়ে আর বেশি উপকারি হ’তে চাই না, সহজেই বশ মেনে যায়
এমন মানুষ হ’তে চাই না। ছোট বাচ্চাদের মাঠ থেকে উপড়ে
সভ্যতার পাঠশালায় নিয়ে যেতে চাই না। তাদের শেখাতে চাই না যে
তারা(তারা নয়) ঘাসের থেকে অনেক বেশি ভালো।

৫। সমুদ্রের কিনারায়

এ গান আমি আগে শুনেছি,
শরীর বলল।


৬। বাগান

কেল শাকের গুটানো হাতা
ক্যাপসিকামের ফাঁপা ঘন্টা
পিঁয়াজের বার্নিশ ক’রা রঙ।

বীট, তারার মত নীলমণি ফুল, টমেটো
সবুজ শিম।

আমি ভিতরে এসে সবকিছু
কাউন্টারের উপর রাখলাম - চাইভ, পার্সলি, ডিল,
ফ্যাকাশে চাঁদের মত কুমড়ো,
মটরশুঁটি - তাদের রেশমি জুতার ভিতর,
অপূর্ব সুন্দর বৃষ্টিভেজা ভুট্টা।


৭। অরণ্য

রাতে গাছের নিচে
কালো সাপটা
এঁকেবেকে চলে
খস্‌খস্‌ শব্দ,
চলে ব্লাডরুট ফুলের বোঁটা, হলুদ পাতা, গাছের ছাল-বাকল ঘষে,
যেন পুরাতন জীবনটা ছিনিয়ে নেবে।
আমি জানি না
যা কিছু ঘটছে
তা সে জানে কিনা ।
আমি জানি না
এটা কাজ করবে নাকি করবে না
তাও সে জানে কিনা ।
দূরে চাঁদ আর তারারা
অল্প আলো দেয়।
দূরে প্যাঁচা কেঁদে ওঠে।

দূরে প্যাঁচা কেঁদে ওঠে।
সাপ জানে যে এইসব প্যাঁচার জঙ্গল,
এইসব মৃত্যুর বনভূমি,
এইসব কষ্টের বনভূমি,
যেখানে তুমি কেবল হামাগুড়িই দিয়ে যেতে থাক,
যেখানে তুমি গাছের খোলসের ভিতর বেঁচে থাক,
যেখানে তুমি গাছের ছোটখাট বুনো ডালপালার ভিতর শুয়ে থাক
আর তারা তোমার ভর নিতে পারে না,
এখানে জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই,
এবং তা না সামাজিক, না বুধিদীপ্ত।

এখানে জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই,
এবং তা না সামাজিক, না বুধিদীপ্ত,
বৃষ্টি শুরু হ’য়,
চারদিকে
ফুলের শরীরের মত গন্ধ
ছড়িয়ে পড়তে শুরু ক’রে।
ঘাড়ের পিছনে পুরনো চামড়া ফেটে যায়।
সাপ কেঁপে ওঠে
কিন্তু ওর কোনরকম দ্বিধা নেই।
সে ইঞ্চি ইঞ্চি এগিয়ে যায়।
সে রক্তাক্ত হ’তে শুরু ক’রে
রেশমি স্যাটিনের মত।